মহাবিশ্বের সম্পর্কে একটি প্রচলিত ধারণার মধ্যে একটি হচ্ছে মহাবিশ্বের পরিধির প্রসারণ অর্থাৎ মহাবিশ্বের আয়তনের বেড়ে যাওয়া। এই আয়তন বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ ই হচ্ছে ডার্ক এনার্জি।
ডার্ক এনার্জি কি আসলে শক্তির রূপ? তাহলে এটি ডার্ক এনার্জি কেন হবে? কারণ এটি অবশ্যই শক্তি বা এনার্জির ই একটি রূপ কিন্তু তা দৃশ্যমান নয় স্বাভাবিক দৃষ্টিতে। খালি চোখে তো না ই খুব উন্নত মানের টেলিস্কোপ বা লেন্স দিয়েও দেখা সম্ভব নয়। তাহলে এর অস্তিত্বের প্রমান আসে কিভাবে? এর অস্তিত্বের প্রমান আমরা পাই এর মধ্যকার প্রচন্ড মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে।
তবে এক্ষেত্রে এই শক্তি টির ধরন একটু ব্যতিক্রম। এটি অভিকর্ষ বলের মত সব একটি কেন্দ্র বিন্দুতে আকর্ষণ করে না বরং একটি তীব্র বিকষর্ণ শক্তি এখানে কাজ করে। এই বিকর্ষণ শক্তি ই মহাবিশ্বের যে বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা তাকে করছে জোড়ালো। তাই এটি একটি কারন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণে।
ই সম্পর্কিত ধারণা পাওয়া যায় সুপারনোভার জন্যে করা তথ্যসূত্র থেকে।সুপারনোভা একটি ধ্রুবক আলো বিচ্চুরণ করতে থাকে যার মানে এটি একটি নির্দিষ্ট মানে আলো বিকিরণ করতে থাকে যেটি থেকে একটি দূরত্ব পরিমাপ করা সম্ভব আলোর গতি নির্ণয়ের মাধ্যমে। এই দূরত্ব এবং রেডশিফট যা কি না সুপারনোভাটি যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছে সেটির গতির পরিমাপের তুলনা করা হলে বোঝা যায় মহাবিশ্ব আসলে কি গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। নানান ধরনের ধারণা থেকে বুঝতে পারা যায় যে মহাবিশ্বের পদার্থ আর শক্তির মধ্যকার আকর্ষণ বল সময়ের সাথে মহাবিশ্বের এই আয়তনের বেড়ে যাওয়ার গতিকে কমাতে সাহায্য করবে।
যেহেতু নানান ভিন্ন কারনেও এটিই সমর্থিত যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে তাই বলা যায় ডার্ক এনার্জির অস্তিত্বও রয়েছে। তবে ডার্ক এনার্জির মূল গঠন বা এটি আসলে কি সেটি এখনো অজানা। এ বিষয়ের মূল ধারণা তে রয়েছে দুইটি উপাদান, একটি কন্সট্যান্ট বা ধ্রুবক যেটি কসমোলজিকাল বা মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট মান।সহজে বললে হয় কসমোলজিকাল কন্সট্যান্ট বা মহাবৈশ্বিক ধ্রুবক মান।এই ধ্রুবকের মান টি আসলে এই ডার্ক এনার্জি বা শক্তি যে বলে সময় এবং তলের সাথে যে ঘনত্বে কাজ করে সেটির পরিমাপ।আরেকটা উপাদান হচ্ছে একটি স্কেলার আয়তন যার শুধু মান আছে কিন্তু দিক নেই। ডার্ক এনার্জি স্কেলার আয়তনের ঘনত্বের মধ্যে কাজ করে। সময় এবং তল বা স্পেসের তারতম্য অনুযায়ী ডার্ক এনার্জির কম বেশি হবে না কারন কসমোলজিকাল ধ্রুবকের মান নির্দিষ্ট কিন্তু স্কেলার আয়তনের পরিবর্তন হতে পারে। যেহেতু মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে তাই আলোর তরংগের দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্যালাক্সি সমূহের এই মধ্যবর্তী আলোক দূরত্ব বৃদ্ধিই প্রমান করে যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এতে ডার্ক এনার্জি সরাসরি ই দায়ি।
ডার্ক এনার্জির মধ্যকার তীর্ব বিকর্ষণ বল রেডশিফটকে সময়ের সাথে দূরে নিতে থাকে। ১৯৯০ সালে প্রথম জানা যায় আসলে আমরা যে গতিতে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হবে ভেবেছিলাম তার থেকে বেশি গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাকর্ষ বা অভিকর্ষ শক্তি এর গতি এতে তুলনামূলক কম প্রভাব ফেলছে। তাই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সময়ের সাথে গতিহীন থেকে সম্প্রসারণের গতিতে পৌছায় এবং গ্যালাক্সি থেকে রেডশিফটের দূরত্ব বাড়ে। নাসার হাবল টেলিস্কোপের একটি প্রধান কাজ হলো ডার্ক এনার্জির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে সেটি আসলেই ডার্ক এনার্জি কিনা তা পরীক্ষা এবং সাধারণ অবস্থার বাইরে ডার্ক এনার্জির ব্যবহার নিয়েও গবেষণা করে। মূলত তারাই এটি প্রমান করে যে দুই যুগ ধরে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ কিভাবে গতিশীল থেকে গতিহীন অবস্থা তে পৌছায়। যা আরো প্রমান করে ডার্ক এনার্জির অস্তিত্বের। রেডশিফট বাড়ার সাথে স্বসম্প্রসারিত হয় এবং আলোক তরংগের সাথে ডার্ক এনার্জির সম্প্রসারণমুখী বলের জন্যে সামনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে যখন আস্তে আস্তে গতিহীন অবস্থা তে যেতে থাকে তখন এই বল সম্প্রসারণের পেছনের দিকে আসতে থাকে। মহাবিশ্বে ৬৮% থেকে ৭২% পর্যন্ত ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব দেখা যায়। বাকিটা ২৬% ডার্ক ম্যাটার আর ৫% ব্যারিয়নিক পদার্থ যা সাধারণ পদার্থ নিউট্রন এবং প্রোটন দিয়ে গঠিত এবং অল্প কিছু সংখ্যক পজিট্রন, নিউট্রিনো বিদ্যমান।
ডার্ক এনার্জি কে এক হিসাবে এভাবেও বলা যায় এটি মহাকর্ষ বা অভিকর্ষ আকর্ষণ বলের বিপরীত বল। এটি একটি নেগেটিভ মানের ভরের বল যা পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে আছে। মহাকাশে পর্যাপ্ত পরিমান ম্যাধ্যাকর্ষণ বলের অনুপস্থিতির কারন এই নেগেটিভ মানের ভর ডার্ক এনার্জি যা একটি তীব্র বিকর্ষণ বল। তবে ডার্ক এনার্জি ঘনত্ব কম। এটি আলাদা থাকে কারন বিকর্ষি বল, ছড়িয়ে পড়ার সময় ব্যাপন প্রভাব এদের ঘনত্ব কম করে সব দিকে সমান ভাবে ছড়িয়ে পড়ে পানিতে লবন যেভাবে সমান ভাবে মিশে যায় সেভাবে। এটির এই বিকর্ষি বলের ঘনত্ব ৭*১০-৩০ গ্রাম পার সেন্টি মিটার কিউব বা একটি এক সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা যুক্ত স্ক্যালার ক্ষেত্রে ৭*১০-৩০ গ্রাম নেগেটিভ ভরের বিকর্ষন বল কাজ করে।
মূলত শক্তির সংরক্ষণশীলতার সূত্রে যেভাবে বলা শক্তির মোট পরিমাণ সমান এর শুধু এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তন হয়। ঠিক ডার্ক এনার্জির এই নেগেটিভ ভর ম্যাধ্যাকর্ষন শক্তির পরিবর্তিত রূপ। ডার্ক এনার্জির মূল গাঠনিক রূপ এখনো অজানা। তবুও এর এত প্রকট অস্তিত্বের প্রকাশ পাওয়া যায়। কারন এর আকার। মহাবিশ্বের সমগ্র আয়তন জুড়েই এর ব্যপ্তি। আশা করাই যায় সুদূর ভবিষ্যতে ডার্ক ম্যাটার এর সাথে ডার্ক এনার্জি সম্পর্কেও আরো নানান তথ্য জানা যাবে।
Naila Huq- Science Writer