বাঘ থাকতে পারে জেনেই পালালো লোকটি। অথবা দিপা, রান্নাঘরে আরশোলা উড়ে গায়ে বসা মাত্রই ভয়ে চীৎকার দিয়ে উঠলো । কিন্তু কেন?
এগুলাকে আমরা ভয় হিসেবেই জানি।
আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক। আমরা হুট করে আধুনিক সমাজে কেতা দুরস্ত হয়ে ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখার মত ঝটপট স্মার্ট হইনি।
আমাদের মানব সভ্যতা হাজার নয়, লক্ষ বছরের পুরনো।
সবাই না , তারপরেও খেয়াল করলে দেখা যাবে, ছোটবেলায় সবাই অন্ধকারকে কম বেশি ভয়ে পায়। কিন্তু কেন?
এর একটা কারণ হতে পারে , মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল, তখনও আগুন আবিষ্কার হয় নাই। আচমকা রাতে গুহায় বনের হিংস্র জন্তু ঢুকে পড়তো। শুধু জন্তু না, বিষাক্ত পোকার কামড়েও অনেকে মারা যেত।
আমাদের এই আদি ভয় এখনো আমাদের থেকে পুরোপুরি যায় নাই।
তাই কোন কারণ ছাড়াই – অনেকের অন্ধকারকে বেজায় ভয়, বিছে , আরশোলা মানে পোকা মাকড়কে বেজায় ভয়।
এখন আসি, ভয় না পেলে কি হত?
এটা কিন্তু একদিক থেকে ভয়ঙ্কর প্রশ্ন। ভয় জিনিস একেবারেই না থাকলে মানব সভ্যতা হুমকির মুখে পড়তো।
পোকাকে ভয় না পেলে, বনে বাদাড়ে আমরা বিষাক্ত পোকার অনেক কাছাকাছি চলে জেতাম, কামড় খেতাম , মারা যেতাম। ( এর মানে হল এই অভ্যাস আদি যুগে না থাকলে মানুষের সংখ্যা কমতো- টিকে থাকাই আসল ব্যাপার তা আপনি ভিতুর ডিম হলেনই বা )।
অন্ধকারকে কেন ভয় ? কারণ অন্ধকার মানেই আপনার কাছে তথ্য এর অভাব। আপনি জানেনা জঙ্গলের ভিতর এই অন্ধকারে ঠিক কি কি আছে? ফলে আপনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে পারেন। তাই ভয় পাচ্ছেন।
এবার আসেন আরো বাড়িয়ে বলি। আপনি বনে ভয়ে ঢুকছেন না ভয়ে, হুট করে আপনার বন্ধু হাফিজ এসে হাজির জনা দশেক হোমড়া ছোমড়া লোক সমেত। তাঁদের হাতে বন্ধুক আর আগুনের মশাল।
এই পর্যায়ে এসে হ্যাঁ এই পর্যায়ে এসে আপনার ভয় কমে যাবে। আপনি তখন লোক সমেত বনটি পার হবার সাহস পাবেন?
কিন্তু কেন? আপনার মনের চিন্তা তখন কাজ করে, আপনি বিপদে পড়লে সাথের লোকজন আপনাকে উদ্ধার করতে পারেব।
আরে আরে থামেন, এখানেই শেষ না, সাথে লোকবল থাকলেই যে ভয় উড়ে যায় তা না। ধরা যাক একটা বড় সড় বিমান। মাঝ আকাশে বেশ কাঁপুনি দিচ্ছে বিমান। যাত্রীরা সবাই দেখছে বিমানের পাশের ডানায় আগুন লেগে গেছে। তখন ১০০ জন মানুষ আপনার সাথে থাকলেও আপনি সহ সবাই ভয় পাবে, কারণ প্রায় সবাই বুঝে গেছে এখানে বিপদে পড়েছে সবাই, উদ্ধার হবার সুযোগও তাই কম।
একই কথা মাঝ সাগরে কোন জাহাজ ঝড়ে কবলে পড়ে মারাত্মক দুলুনি শুরু হলেও হাজার যাত্রী এক সাথে ভয় পাবে।
এ তো গেল জন্তু, পোকা মাকড়, অন্ধকার, নিরাপত্তার অভাবের ভয়ের কথা।
কিন্তু ভুতের ভয়? সে আবার কি?
ভুতের ব্যাপারে এসে ভয় ও বিশ্বাস, শব্দ দুটি চলে আসে। বিশেষ করে বিশ্বাস। আমি একবার রাত দুটোর সময়, তখন গ্রামে বিদ্যুৎ আসে নাই। খালাতো ভাই সমেত রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, হুট করে মনে হল সামনে এক সাদা বুড়ো মাথা নিচু করে আছে।
আমি বলে উঠলাম- এই রে, এটা কিরে বাবা। বু বুড়ি!!!
আমার ভাই তখন তাঁর কম পাওয়ারের নিভু নিভু টর্চের আলো ফেলে কাছে যেয়ে হেসে ফেললো। আর বললো, এই দেখ তোর বুড়ি।
কেউ একজন কলা গাছের পাতা কেটে এমন করে রাখছে যে পাতা বেশ নিচু হয়ে আছে, আর কলা গাছের কান্ড সহ দূর থেকে এমন মনে হচ্ছে যে একজন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু কেন আমি ভয় পেলাম।?
এখানে বিশ্বাস নামক জিনিসটি কাজ করছে। যা দৃশ্যমান নয়। অনেক সময় মানুষদের মস্তিষ্ক নিজে থেকে নানা রকম বিভ্রম তৈরী করে।
আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। পাতা কাটা নিচু হয়ে থাকা কলা গাছ আমার মস্তিষ্ক একটা রেন্ডারিং করেছে, কে জানে আমার গবেট মস্তিষ্কটা ভালোর জন্যই করেছে।
যদি সত্যি সেখানে এলাকার কানা মুক্তাদির ছিনতাই এর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো?
মনোবিজ্ঞান উন্নত হওয়ার আগে, মস্তিষ্কের নানা রোগ বিষয়ে জানতে পারার আগে, মানুষের পক্ষে এই বিষয়গুলো বুঝতে পারা সম্ভব ছিল না।
সেই ভাবনা থেকেই মানুষের মধ্যে জ্বীন, পরী, ভূত, পেত্নী ইত্যাদির ধারনা প্রবেশ করে। এর ভিতরে আগুনে ঘী ঢেলেছে যুগের পর যুগ চলে আসা মিথ, বড়োদের ভুতের ভয় দেখিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ানো আর গল্পে ভুতের আগমন।
আমি আর আমার ছোট ভাই অনেক ছোট থাকতে ভয় পেয়েছিলাম। তা ভয়টা প্রথমে আমার মত আস্ত গবেট মানুষটাই পেয়েছিলাম। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পাশের জানালা দিয়ে দেয়ালে বিশাল একটা মোরগের ছায়া। এই রে— দিলাম চিল্লানী। এখন তো ভয় তো সংক্রামক, কোন কারণ ছাড়াই আমার ছোট ভাইও সুর মিলিয়ে চিল্লালো।
চীৎকার শুনেই, পাশের রুম থেকে বাবা মা হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলো।
এই কি হয়েছে? আমি ভয় পাওয়া গলায় আঙ্গুল দেখিয়ে জানালা দেখালাম- বড় মোরগ ওই যে।
এরপর আব্বা হেসে সবাইকে নিয়ে বাইরে এসে দেখালো আসলে কি।
পাশের রাস্তার আলো এসে কাঁঠাল পাতার ছায়া দেয়ালে পড়ছে। গাছের পাতাগুলোর ছায়া মিলে কিছুটা মোরগের মত হয়ে গেছে। আব্বা হেসে বললো এই যে তোদের মোরগ।
ইতিমধ্যে আম্মা দায়ে লবণ পুড়িয়ে বললো,নে খা।
এই লবণ খাবার ব্যাপারটা অনেক পরে জেনেছি।
প্রাচীন মিশরীয়, গ্রিক ও রোমানরা উৎসর্গ হিসেবে লবণ ব্যবহার করতো। তখন ধারনা করা হত, খারাপ আত্মা লবনকে ঘৃণা করে। আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের মানুষ বিশ্বাস করতো খারাপ আত্মা যে মানুষে ভর করে, তাঁর ত্বককে লবণ জল দিয়ে দুতে হয় এতে সেই খারাপ আত্মা আর প্রবেশ করতে পারে না।
সে মিথের উপর ভর করে যুগের পর যুগ কোন কারণ ছাড়াই ভয় পেলে লবণ পুড়িয়ে খাওয়ানো হয়। এখন অবশ্য সেই চল অনেক কমে গিয়েছে।
লেখক-জাহিদ শামস